JuboKantho24 Logo

ধনীর কতটা ধন প্রয়োজন

ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে দারিদ্র্য। এর ফলে বিশ্ব চলছে একদেশদর্শী নীতিতে। যা কাটিয়ে উঠতে পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। নেচার ডটকম অবলম্বনে সালাহ উদ্দিন শুভ্র

প্রতি বছর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে জানা যায়, ধনী আরও ধনী হচ্ছে। এরসঙ্গে বিশ্ব জুড়ে বাড়ছে দারিদ্র্য। গত কয়েক দশকে এ চিত্র আরও স্পষ্ট হয়েছে। অথচ সভ্যতার শুরু থেকে ব্যক্তির সম্পদের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের কথা বলে আসছিলেন দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। ধর্মগ্রন্থগুলোতে ধনীদের সম্পদের পরিমাণ, আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। ধনী ও গরিবের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন ছাড়াও দাসপ্রথার বিলুপ্তি, ঋণ মওকুফের কথা বলা আছে সব ধর্মে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে সম্পদের বৈষম্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলেছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৪২ সালে যুক্তি দিয়েছিলেন, ধনী ব্যক্তির বার্ষিক আয় চার লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলারের সমান হওয়া উচিত। তীব্র হয়ে ওঠা অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রভাব পড়ছে সমাজ ও রাজনীতিতে। সরকারগুলোকে চলতে হচ্ছে ধনীদের কথামতো। পশ্চিমা বিশ্বে এ সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সব দেশকে। আন্তর্জাতিক গবেষকরা যার সমালোচনা করে আসছেন। তারা বিভিন্ন তত্ত্ব এবং পরামর্শ দিচ্ছেন।

চলতি বছর সম্পদ বণ্টনের এ বৈষম্য নিয়ে একটি বই আন্তর্জাতিক মাধ্যমে আলোচনায় আসে। বইটির লেখক নেদারল্যান্ডসের ইউট্রেখট বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও অর্থনীতির অধ্যাপক ইনগ্রিড রবেইন্স। তার বইটির নাম সংক্ষেপে ‘লিমিটারিয়ানিজম’। নেচার ডটকমে ধনীদের সম্পদের সীমা নির্ধারণ বিষয়ে ওই বই নিয়ে লিখেছেন ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি সহযোগী অধ্যাপক লুকাস চ্যান্সেল।

রবেইন্স অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অর্মত্য সেনের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

সীমাবদ্ধতাবাদ

লুকাস তার প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ইউরোপে ‘সীমাবদ্ধতাবাদ’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সীমাবদ্ধতাবাদ বলতে সম্পদের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়াকে বুঝানো হয়। গবেষক ও দার্শনিক ইনগ্রিড রবেইন্স এ নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি সম্পদের মালিকানার সীমা নির্ধারণের অর্থ কী হতে পারে এবং কেন তা করা উচিত সেটি অনুসন্ধান করেন। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, একুশ শতকের সরকারগুলোর এ বিষয়ে কাজ করার সময় এসেছে। রবেইন্স এমন সময়ে এ কাজ করছেন যখন এক শতাংশ ধনী মার্কিনি দেশটির ৯০ শতাংশ সম্পদের মালিক। চলতি বছরের শুরুতে ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেক্সের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর সম্পদ বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।

রবেইন্স অবশ্য বলছেন, সরকারগুলোর উচিত ব্যক্তিপ্রতি ১০ মিলিয়ন ইউরো বা মার্কিন ডলার সম্পদের সীমা নির্ধারণ করা। তার পরামর্শ এটি রাজনৈতিক ও নৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে কার্যকর হবে। প্রশ্ন ওঠে, কেন ১০ মিলিয়ন ইউরো বা পাউন্ড সম্পদে সীমাবদ্ধ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে ইউরোপ জুড়ে তার গবেষণা পরামর্শ দেয় যে, এ স্তর বা এমনকি এরচেয়ে কম সম্পদের সীমারেখা জনগণ দ্বারা ব্যাপকভাবে গৃহীত হবে। নেদারল্যান্ডসে রবেইন্স এবং তার দল জরিপ চালিয়ে দেখেছে, দশজনের মধ্যে ৯ জন উত্তরদাতা এ মত দিয়েছেন, চারজনের একটি পরিবারের জন্য চার মিলিয়ন ইউরোর বেশি সম্পদ থাকতে পারে। একটি প্রাসাদ, একটি দ্বিতীয় বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়ি এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ সঞ্চয় থাকলে তাদের অতি ধনী বলা যাবে। নিম্ন আয়ের দেশে এ পরিমাণ অনেক কম হওয়াই স্বাভাবিক।

রবেইন্স উল্লেখ করেন, অধিক সম্পদ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘অনৈতিক এবং অপরাধমূলক অনুশীলনের সঙ্গে আবদ্ধ’। প্রমাণ হিসেবে তিনি অতি ধনী ব্যক্তি এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির ব্যাপক অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন। আইনের চোখে না হলেও তার বিচারে এমন অনুশীলন অনৈতিক হিসেবে বিবেচিত। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বর্তমান সম্পদের বৈষম্যের শেকড় রয়েছে দাসত্ব প্রথা (শ্রম শোষণসহ) বা সামরিক বিজয়ের মতো ঐতিহাসিক কার্যকলাপের মধ্যে। রবেইন্স পরামর্শ দেন, সম্পদ আহরণ সীমিত করলে সমাজ সামগ্রিকভাবে আরও ভালো হয়ে উঠবে।

রবেইন্স বইটি প্রকাশের পর জানিয়েছেন, সীমাবদ্ধতাবাদ সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের মতো নয়। এর মানে হলো, আপনি একটি নির্দিষ্ট মাত্রার অসমতা গ্রহণ করতে পারেন। কেউ ৪০ ঘণ্টা কাজ করলে যে ২০ ঘণ্টা কাজ করে তার চেয়ে বেশি উপার্জন করবে। এর সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই। মানুষের উচ্চাকাক্সক্ষা থাকা ভালো, তারা যা করে তার জন্য অর্থ প্রদান করা উচিত, তবে একটি সীমাও থাকা উচিত। তিনি বলেন, সীমাবদ্ধতা মানে বৈষম্যকে সীমাবদ্ধ করা, পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট মাত্রার অসমতাকেও গ্রহণ করা। সীমাবদ্ধতাবাদ বলতে এটি বুঝায় যে, আপনি কতটা সম্পদ জমা করতে পারেন তার একটি নৈতিক সীমা থাকা উচিত। সম্পদ সীমার ধারণাটি আসলে হলো যে আপনি সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে সংস্কারের চেষ্টা করেন যাতে এটি বৈষম্য হ্রাস করে। সম্পদের সীমা বিষয়ে রবেইন্স বলেন, আমি আরেকটি ব্যক্তিগত সীমাও উল্লেখ করি, ১ মিলিয়ন ইউরো। একটি পরিবারে দুই বা চার মিলিয়ন ইউরো ভালো জীবন যাপনের জন্য যথেষ্ট। কেন একজন ব্যক্তির বেশি থাকতে হবে? পৃথিবীতে আগুনে জ্বলছে এবং আগুন নেভানোর জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের কাছে প্রচুর অর্থ রয়েছে যা তাদের একেবারে প্রয়োজন হয় না। তাই আমাদের অতি ধনীদের কাছ থেকে টাকা পেতে শুরু করা উচিত। এরপর মধ্যবিত্ত থেকে এবং অবশ্যই দরিদ্রদের থেকে নয়।

শীর্ষে ভারী

লুকাসের প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক লেখালেখিতে দেখা গেছে, শীর্ষে বেশি সম্পদের অর্থ নিচের অংশে সম্পদের পরিমাণ অনেক কমে যাওয়া। রবেইন্সের মতে, ওপরের দিকে সম্পদের ঘনত্ব বেশি থাকলে তা শুধু দরিদ্র মানুষকে প্রভাবিত করে না, প্রত্যেকের জন্য এটি সমস্যার। এ বিষয়টি বুঝাতে রবেইন্স বলছেন, গত দুই দশকে গবেষকরা দেখিয়েছেন কীভাবে মিডিয়া টাইকুন, জনহিতৈষী সংস্থার ধনী প্রতিষ্ঠাতা এবং বৃহৎ রাজনৈতিক দলের দাতারা অসম রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ক্ষুন্ন করছেন। কিছু ব্যক্তির অত্যধিক সম্পদ অর্জন কীভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জলবায়ু বিপর্যয় প্রশমনের মতো জনমুখী খাতে সরকারি বরাদ্দ সীমিত করছে। আর যখন চরম সম্পদ বৈষম্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়, তখন কোনো দেশে মেধাবীরা বিপন্ন বোধ করে। এ জন্য রবেইন্স পরামর্শ দেন, উত্তরাধিকার সূত্রে কেউ মোট দুই লাখ পাউন্ড পেতে পারে।

তিনি বলতে চেয়েছেন, বাদবাকি সম্পদ রাষ্ট্র অল্পবয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে বিতরণ করবে যাতে প্রত্যেকে ভালোভাবে চলতে পারে। কারও হাতে সঞ্চিত অনেক অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমষ্টিগত সমস্যা মোকাবিলার মতো ভালো কাজে ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছেন রবেইন্স। তিনি বলেন, পানি বা বিদ্যুৎশক্তির মতো খাতে ধনীদের অতিরিক্ত অর্থ কাজে লাগানো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে সহজ হবে।

ধনীর হাতেই সব

ধনীরা অতিরিক্ত টাকা কীভাবে ব্যয় করে তাও দেখতে বলেছেন রবেইন্স। তিনি বলছেন, যেমন আইরিশ-আমেরিকান বিলিয়নিয়ার চাক ফিনি, যিনি বিমানবন্দরে শুল্কমুক্ত দোকানগুলো থেকে একচেটিয়া অর্থ উপার্জন করেছেন। তিনি প্রায় সব অর্থ বিলিয়ে দিয়ে নিজের উপার্জনকে সর্বোত্তমভাবে উপভোগ করেছেন। জেফ বেজোসের প্রাক্তন স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি স্কট বছরে বিলিয়ন ডলার বিলিয়ে দিচ্ছেন।

নিজের বই বিষয়ে দ্য গার্ডিয়ানকে চলতি বছরের শুরুতে রবেইন্স বলেন, মূলত আমি বইটির মাধ্যমে আর সবার মতো সামাজিক লক্ষ্য হিসেবে দারিদ্র্য দূর করতে চাই। আমাদের অবশ্যই অতি ধনী লোকের সংখ্যা এবং সম্পদ কেন্দ্রীকরণের পরিমাণ হ্রাস করা উচিত। তিনি বলেন, তার বইটি কেবল সামাজিক সংহতি এবং গণতন্ত্রের ওপর নয়, বরং উৎপাদনশীলতা, সামাজিক মানসিকতার ওপর নেতিবাচক পরিণতিগুলো অন্বেষণ করে। পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর। তার বই কোনো পরিবর্তন আনবে কি না, এমন প্রশ্নে এ লেখিকা বলেন, আমার বই পড়ে অনেকে প্রশ্ন করবেন, আমি কী করতে পারি? এটাও মনে হতে পারে, কীভাবে পৃথিবীকে আমরা ঠিক করতে পারি? আমার উত্তর হলো, আমরা যারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অবস্থানে আছি, তাদের কর্তব্য নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া, যুক্তি উপস্থাপন করা। স্বেচ্ছাসেবক সম্প্রদায়ের সঙ্গে জড়িত হন। আমি একজন স্বাভাবিক হতাশাবাদী, তবে হাল ছেড়ে দেওয়া কোনো বিকল্প নয়।

রবেইন্স গণতন্ত্রের প্রয়োজনে সীমাবদ্ধতার পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতি ধনীদের উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলেন, তাদের আর্থিক সম্পদকে তুলনামূলক সহজে রাজনৈতিক ক্ষমতায় পরিণত করা হয়। তারা এমন কাউকে অর্থায়ন করতে পারেন যিনি জনপ্রতিনিধিত্বের জন্য দাঁড়াচ্ছেন এবং তারপর হয়তো রাষ্ট্রপতি বা কংগ্রেসের সদস্য হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থায়নের প্রসঙ্গও তিনি উল্লেখ করেন। যার মাধ্যমে ধনীরা জনসাধারণের কথোপকথনও নিয়ন্ত্রণ করে।

রবেইন্সের বইটি ইউরোপে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে একে ন্যায্য দাবি করে কথা বলেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন উপহাসমূলক। কীভাবে ধনীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা রবেইন্স দিতে পারেননি বলে মত তাদের। যদিও রবেইন্স আসলে একটি বিষয়কে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন, আর তাহলো নৈতিকতা। নৈতিক অবস্থান থেকে বিশ্বকে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। যদি ধনীরা নৈতিক আচরণ করে তাহলে তাদের পক্ষে নিজেদের সম্পদের সীমারেখা টানা সম্ভব। আর যদি তারা নৈতিক না হন, তাহলে সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় তাদের ওপর চাপ তৈরি করা।

Jubokantho24 Ad
এ জাতীয় আরো সংবাদ
এ জাতীয় আরো সংবাদ