JuboKantho24 Logo

মোগল শহর: ভারতীয় মুসলমানদের নগর সংস্কৃতি

মোগল সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে স্থায়ী ছিলো। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের দুই প্রভাবশালী সাম্রাজ্য তুরস্কের উসমানি ও পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্যের চেয়েও আয়তন ও সম্পদের দিক থেকে বিশাল ও সমৃদ্ধ ছিলো মোগলরা। এসময় তারা উপমহাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে উন্নতি সাধন করে এবং ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চায় ব্রতী হয়। এজন্য জায়াগায় জায়গায় গড়ে ওঠে শহর-নগর। মানুষজনও নগরমুখী হতে থাকে। আমরা তাই এই সাম্রাজ্যের নগরায়ণ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

মোগল সাম্রাজ্যের শহরগুলোর কাঠামো বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, এখানে শহরগুলোর নগরায়ণ বিশেষত চার শ্রেণির। ১. প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী। ২. শিল্পপণ্যের উৎপাদনের জন্য বাণিজ্যিক নগরীর যাত্রা । ৩. ধর্মীয় ভাবাবেগের ফলে তীর্থস্থানগুলোকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠে কিছু শহর। ৪. শিল্প-দক্ষতার ওপর নির্ভশীল শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে ওঠে কিছু নগরী।

শহরের বিস্তৃতির কারণ হলো, দেশে স্থল ও জলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিলো। আবার নাগরিক সকল সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান ছিলো সাম্রাজ্যের শহরগুলোতে। প্রথমতো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চাঙ্গা হয় একই ওজন, পরিমাপ ও মুদ্রার প্রচলন সবখানে চালু হবার কারণে। আবার আভ্যন্তরীণ শুল্ক তুলে দেওয়া হয় ব্যবসা বিস্তৃত হবার জন্য। বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই মোগলযুগে অনেক শহর গড়ে উঠেছিল। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মনে করেন, ‘মোগল-সম্রাটরা যে রাজনৈতিক অবস্থার উদ্ভাবন করেছিলেন, তা তাদের অভ্যন্তরীণ নীতির বিশেষ করে কৃষি ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন শহর ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য কেন্দ্রের ইউরোপীয় বাণিজ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠা এবং ইউরোপীয় বাজারগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন মোগলযুগের অর্থনীতিকে বলবান করেছিল, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিলো নগরায়ণের ওপর। উত্তরের দিল্লি, আগ্রা, আহমেদাবাদ, সুরাট ও ঢাকা শহরের দ্রুত সম্প্রসারণ এই সময় ঘটেছিল।’

আবার দ্রুত নগরায়ণের আরেকটি কারণ হলো, কৃষকরা দলে দলে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার দ্রুত প্রসার ঘটে। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র বিশ্বাস করেন, ‘রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের জন্য কৃষক শ্রেণী ক্রমাগত ভিখারিতে পরিণত হওয়ার একমাত্র কারণ নয়, শহরগুলিতে উন্নত মানের জীবনযাত্রা ও নগদ মজুরির প্রলোভনও ছিলো|

এবার আসা যাক শহরগুলোর অবকাঠামোগত আলোচনায়। বিভিন্ন কারণে নগরের বৃদ্ধি ঘটলেও, তার স্থায়িত্ব হয়েছিলো বাণিজ্য-সুবিধা, সুরক্ষিত স্থান, পরিবহন-সুবিধার ফলে। বিশেষত নদীর কোল ঘেঁষে শহরগুলো স্থাপিত হয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সংরক্ষণ, জলপথে মালামাল আনা-নেওয়া ইত্যাদি কারণে। সাম্রাজ্যের রাজধানীগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে মোগল আমলের শহরগুলোর নগরায়ণ পরিকল্পনা, তার রূপ-সৌন্দর্য ও স্থাপত্যশিল্প সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ।

মোগল সম্রাটরা যুদ্ধসহ নানা কারণে প্রায়ই সফরে থাকতেন। বিভিন্ন জায়গায় বিশ্রাম ও যুদ্ধের ময়দানে অবস্থানের জন্য তাঁবু বা শিবির স্থাপন করা হতো তাঁদের জন্য। আর সেখান থেকেই তাঁরা শহর নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অনুপ্রেরণা পায়। ফতেহপুর সিক্রি ছিলো মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম নির্মিত সুসংগঠিত শহরগুলোর একটি। তা নির্মিত হয়েছিলো তাদের স্থাপিত শিবিরগুলোর গঠন-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন নীতি অনুসরণ করে। এমনকি শিবিরগুলোর স্থাপনাগুলোকে নির্দেশ করতে ফারসি উৎসগুলো থেকে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা বাদশাহর মহল ও আমলাদের ভবনগুলোকেও বর্ণনা করতে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, দরবার হলকে বলা হতো বারগাহ-ই আম বা নাগরিক জমায়েতের জন্য বড় তাঁবু; সম্রাটের ঘুমানো কিংবা বিশ্রামকক্ষকে ডাকা হতো খিলভাত কাদা-ই খাস বা ব্যক্তিগত তাঁবু; হেরেম বা নারীদের আবাসস্থানের নাম ছিলো সারপর্দা-ই ইসমত বা সম্মান বজায় রাখার জন্য পর্দা ঘেরা এলাকা অথবা বলা হতো শাবিস্তান-ই ইকবাল বা সৌভাগ্যবতীর শয়নঘর। শিবিরগুলোর বিভিন্ন তাঁবুর নাম এভাবেই ব্যবহৃত হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে মহলের কক্ষগুলোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

মোগল রাজকীয় শিবিরে কেন্দ্রীয় এলাকাটি বরাদ্দ থাকতো রাজকীয় ব্যবহারের জন্য। এরপর থাকতো শাহজাদাদের আবাস তারপর অভিজাতদের তাঁবু, আরো দূরে এ অঞ্চলের বাইরে বিভিন্ন সেবার স্থাপনা। কোণায় বসতো বাজার। এছাড়া সবখানেই থাকতো মর্যাদা অনুসারে বিন্যাস। আবুল ফজল বলেন, রাজকীয় তাঁবু, ঢোল বাজানোর ঘর রাখা হতো ১,৫৩০ গজের মধ্যে। এগুলোর ডানে-বামে ও পেছনে ৩০০ গজ খোলা জায়গা থাকতো রক্ষীদের জন্য। মূল পরিবেষ্টনের মধ্যে কেন্দ্র থেকে ১০০ গজ দূরে স্থাপন করা হতো আকবরের মা, বোন গুলবদন বেগম ও অন্যান্য অভিজাত নারীদের তাঁবু; ডানদিকের তাঁবুতে থাকতো শাহজাদা জাহাঙ্গীর ও বাঁয়ে শাহ মুরাদের। তাঁবুর পেছনে কিছুটা দূরত্বে স্থাপন করা হতো কারখানা, আরো ৩০ গজ পেছনে শিবিরের চার কোণায় বসতো বাজার। রাজকীয় ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট করা চত্বরের বাইরে অভিজাতরা শিবিরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের পদ-পদবি অনুসারে তাঁবু ফেলতেন।

সতীশ দাভর প্রথম নির্দেশ করেন যে, ‘টপোগ্রাফি যেমনই হোক, মোগলরা তাদের স্থায়ী প্রাসাদ ও সংলগ্ন এলাকা সেই অস্থায়ী শিবিরের নকশাতেই গড়ে তোলার প্রবণতা দেখিয়েছেন, ব্যাপারটা অনেকটা পাথরের স্থায়ী শিবির গড়ে তোলার মতো।’ ফতেহপুর সিক্রি ও মোগল শিবিরের পরিকল্পনার মধ্যে সাদৃশ্য বুঝতে হলে প্রাসাদের স্থাপনাগুলোকে আবুল ফজলের বর্ণিত শিবিরের গঠনের সঙ্গে মিলাতে হবে।

ফতেহপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদে সম্রাট থাকতেন একটি দ্বিতল প্যাভিলিয়নে। একে ঘিরে থাকতো কাপড়ে ঢাকা কাঠের দেয়াল, যার নাম ছিলো গুলালবার। একই পরিবেষ্টনের মধ্যে দু-আশিয়ানার সঙ্গে থাকতো একটি কাঠের স্থাপনা ছোবিন রাভাতি। দু-আশিয়ানাতে ঝরোখা থাকতো, তা একই সঙ্গে সম্রাটের প্রার্থনার ঘর হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এর সামনে অভিজাতরা সম্রাটকে কুর্নিশ জানাতেন। দৌলতখানা-ই খাস বা সম্রাটের ব্যক্তিগত এলাকা এবং নারীদের কোয়ার্টারের মধ্যে মাহতাবি নামে একটা ফাঁকা অংশ ছিলো। মাহতাবির মাঝখানে একটি প্লাটফর্ম, এর ওপর চারটি স্তম্ভের মাধ্যমে তৈরি করা নামগিরাহ বা শামিয়ানা। সন্ধ্যাবেলা সম্রাট এখানেই বসতেন। নারীদের নির্দিষ্ট পরিবেষ্টনের মধ্যে ২৪টি কাঠের রাভাতি ছিলো, এর সঙ্গে ৬০ গজ আয়তনের আরেকটি পরিবেষ্টন। সেখানে থাকতো সশস্ত্র নারীরক্ষী ও অন্যান্য নারী চাকর। আরেকটি পরিবেষ্টনে ৭২টি কক্ষ ও দুই প্রবেশপথ বিশিষ্ট দরবার ছিলো। এভাবে ধারাবাহিকভাবে সাজানো হয়েছিলো রাজপ্রাসাদ। তার বাইরে পুরো রাজধানীজুড়ে ধাপেধাপে স্থাপিত হয়েছিলো অফিস-আদালত অভিজাতদের বাড়িঘর, মসজিদ-ইবাদতখানা তারপর নির্দিষ্ট দূরত্বে সাধারণ মানুষের বসতি ও প্রান্তে সরলরৈখিক অবস্থানে দোকানপাট ইত্যাদি।

ফতেহপুর সিক্রির নকশার আরেকটি সম্ভাব্য উৎস হতে পারে মোগল-বাগান, চাহারবাগ। পেট্রুসিওলির মতে, ‘চাহারবাগের কেন্দ্রমুখী প্রতিসাম্য মোগল নগর পরিকল্পনার অনুপ্রেরণা হতে পারে। বাগানের অক্ষ, সংযোগ কিংবা অর্বুদ স্থাপত্যরীতিতে গিয়ে প্যাভিলিয়ন, চাবুতারাস, ঝর্ণা, জলাশয়, ক্যারাভান সরাই ও গোছানো রাস্তায় পরিণত হয়েছে। এভাবে মডিউলার গ্রিড পদ্ধতিগত নকশা উপাদানে পরিণত হয়েছে। শহর বিভক্ত হয়েছে বিভিন্ন ভাগে, যার কেন্দ্রে ছিল মূল স্থাপনা এবং কেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিসাম্যে সারিবদ্ধ হয়েছে অন্য স্থাপনাগুলো’।

মোগলদের স্থাপত্যাশিল্পে অনেক রীতির মিশ্রণ ঘটেছে। স্বতন্ত্র স্থাপনা বা ভবনের প্রেরণা এসেছে অনেক ঐতিহ্য থেকে। ফতেহপুর সিক্রির নির্মাণকাজ যখন শুরু হয়, ততোদিনে প্রাক-মোগল মুসলিম শাসকদের স্থাপত্যে রাজপুত ও গুজরাটি স্থাপত্যরীতির আত্মীকরণ হয়ে গেছে। ফতেহপুর সিক্রির সৌরম্য ভবনগুলোতে মুখ্য প্রভাব দেখা যায় তৈমুরীয় ও গুজরাটি স্থাপত্যরীতির। আবার অনেক স্থাপনায় দিল্লি সালতানাতের রীতি অনুসারে ধনুকের মতো বাঁকানো, সঙ্গে ট্রাবিয়েট রীতি বা গুজরাটি সালতানাতের আকর্ষণীয় মিশ্রণ দেখা যায়। প্রাসাদ ভবনের উপরে প্যাভিলিয়নগুলোতে মধ্য এশীয় স্থাপত্যরীতির ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। রঙ মহল ও সংলগ্ন কমপ্লেক্স, পঞ্চ মহল, হাওয়া মহল ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে ইরানীয় ও তৈমুরীয় পোস্ট অ্যান্ড বিম পর্চেসের ভিত্তিতে। এসব স্থাপনার ট্রাবিয়েট নির্মাণের ক্ষেত্রে মাপজোখের নিখুঁত ব্যবহার অসামান্য উদাহরণ হয়ে রয়েছে আমাদের জন্য। আকবরের স্থাপত্যের গৌরব ছিলো জ্যামিতিক নির্ভুলতা। এসব স্থাপত্যশিল্প, উন্নত নগরায়ণ পরিকল্পনা মোগলদের রুচিশীলতার পরিচয় যুগযুগ ধরে বহন করে চলেছে।

মোগল রাজধানী প্রাক-শিল্পায়িত যুগের লন্ডন থেকে তেমন ভিন্ন ছিলো না। নাগরিক সুবিধার প্রাথমিক বিষয়গুলো বিবেচনা করলে এমনটাই প্রতীয়মান হয়। ফতেহপুর সিক্রির কথাই ধরা যাক। সিক্রিতে ছিলো বিশাল হাইড্রোলিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সুপরিকল্পিত সড়ক-অলিগলি, বাহারি বাগান, সরাইখানা ও শহরতলির নির্দিষ্ট অবস্থান। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, মোগল স্থাপত্যবিদরা কেবল নগরের ল্যান্ডস্কেপকে নতুন করে নকশা করেন নি, বরং নাগরিক সুবিধার বিষয়গুলোও তারা নকশায় যুক্ত করেছিলেন। মোগল নগর ও রাজকীয় শহরগুলো যে বণিজ্য ও কারুশিল্পের বিকাশমান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, তা প্রমাণ করতে ইউরোপীয় ও ঔপনিবেশিক শহরগুলোর নিদর্শনাদির সঙ্গে মোগল শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে তুলনা করার প্রয়োজন নেই। সমসাময়িক অনেক উৎস ও বিবরণ দেখলেই তা বোঝা যায়।

মধ্যযুগের যেকোনো প্রথাগত শহরেই নাগরিক বসতির কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিলো। এগুলোর অধিবাসীরা কৃষিকাজ করতো না। নগরের চারদিক বিশাল প্রাচীর বা গভীর পরিখা দ্বারা বেষ্টিত থাকতো। পশ্চিম ইউরোপেও ‘টাউন’ বা ‘বার্গ’ টার্মগুলো এসেছে নিরাপত্তা স্থাপনা দিয়ে ঘেরা বড়ো এলাকাকে নির্দেশ করতে; যা ‘যুদ্ধের সময় আশ্রয়’ হিসেবে বিবেচিত হতো। রবার্ট লোপেজ শহরকে চিহ্নিত করেছেন দেয়ালের মধ্যে ‘সংযোগ’ কিংবা ‘সংযোগ সড়ক’ হিসেবে। এ নগরের ধারণা নির্দেশ করে, সুরক্ষিত সামাজিক স্থান এবং নগরে আসা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ। বিভিন্ন এশীয় নগর ও রাজকীয় শহরগুলো দুর্গব্যবস্থা বা গভীর পরিখা দিয়ে সুরক্ষিত ছিলো। ট্রান্স অক্সিয়ানা ও সংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বার্টহোল্ড দেখিয়েছেন, বালখ, বুখারা ও সমরকন্দে শহর ও শহরতলি ঘিরে ছিলো প্রাচীর ও ফটক। আর মোগল শহরগুলো সাধারণত রণসজ্জা, প্রশস্ত দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত থাকতো। লাহোর, আহমেদাবাদ, বারোখ, বারোদা, ক্যাম্বে, সুরাট, দিল্লি ও ফতেহপুর সিক্রি সবই ছিলো দেয়ালঘেরা শহর। আজমীর, মুলতান ও কোয়ল (আধুনিক আলীগড়) ছিলো একই সঙ্গে দেয়াল ও গভীর পরিখা দিয়ে ঘেরা শহরের উদাহরণ। অন্যদিকে আগ্রা কিংবা উজ্জয়নের মতো শহরে দেয়ালের কোনো বেষ্টনি ছিলো না। আগ্রার সুরক্ষায় ছিলো কেবল পরিখা। এসব শহরের প্রান্তসীমায় প্রাচীর নির্মিত হয়েছে এই কেবল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এসব কিছুই প্রমাণ করে, আধুনিক যুগের নগর পরিকল্পনা নতুন আবিষ্কৃত নয়। মোগল সাম্রাজ্য সেই মধ্যযুগেই সুপরিকল্পিত নগরায়ণে উন্নতি সাধন করেছিলো।

এখানে একটা তর্ক আছে যে, ‘মোগলদের নগর গঠন নিয়ে দীর্ঘ পরিকল্পনা ছিলো না। এজন্য বিভিন্ন সময় তারা রাজধানী অন্য এলাকায় সরিয়ে নিয়েছে, একজায়গায় স্থির হয়নি।’ কথাটা ব্যাপকভাবে শুদ্ধ নয়। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কার্লা এম সিনোপলি মোগল রাজধানী স্থানান্তরের ব্যাখ্যা দেখলে তর্কটা আর থাকে না। কার্লের মতে রাজধানী পরিবর্তনের কারণ হলো :
১. সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী রাজনৈতিক, সামরিক ও বস্তুগত পরিস্থিতি।
২. অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাজনিত পরিস্থিতি।
৩. আদর্শগত অবস্থান।
মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তর মূলত এই লক্ষণগুলোর কারণে হয়েছে। ফতেহপুর সিক্রি, লাহোর, আগ্রা, দিল্লি এই শক্তিধর সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো। এই রাজধানী পরিবর্তনের ফলে নগরের বিকাশ ঘটেছে, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এবং পৌরষেবা অনেকাংশে বেড়ে গেছে।

আকবর যখন নতুন রাজধানী আগ্রা স্থাপন করেন।তখন পুরনো সব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন নকশা অনুযায়ী নির্মাণকাজের নির্দেশ দেন। এভাবে যমুনার তীরে গড়ে ওঠে সুশৃঙ্খল আধুনিক এক নগরী। রাজধানী আগ্রার চমৎকার নগরায়ণে মুগদ্ধ হয়েছিলো সেসময়ের গ্রিক-রোমান পর্যবেক্ষকরা। আগ্রার জনসংখ্যা দ্রুত দুই লাখ ছাড়িয়ে যায়। আর শাহজাহানের সময় তা সাত লাখ পার করে ফেলে। তখন নগরবাসী ও বাণিজ্যের সুবিধার্থে আগ্রা-ফতেহপুর সিক্রি-গুজরাট সংযোজন রয়াল করিডোর হাইওয়ে খুলে দেয়া হয়। সম্রাট শাহজাহান যখন দিল্লিকে নতুন আঙ্গিকে রাজধানী হিসেবে গড়ে তুললেন। তখন ইংরেজ পর্যবেক্ষক স্টিফেন ব্লেক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভারতের রাজধানী সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে আর শাহজাহানের সিংহাসন মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত।’ তাই বোঝা যায়, রাজধানী স্থানান্তরের পেছনে শুধু খেয়ালিপনা ছিলো না। ঐতিহাসিক কারণও বিদ্যমান ছিলো। আর তা সুচিন্তিত মতামতের ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছিলো।

তিনশো বছরের স্থায়ী এই মোগল সম্রাটদের রুচিবোধ, সৃজনশীলতা ও সুদক্ষ পরিচালনার সাক্ষ্য হয়ে আছে মোগলদের ছোটো-বড়ো নগরী ও রাজধানীগুলো। সুরৌম্য ভবন আর জাঁকজমকপূর্ণ আলীশান মহলগুলো বিশেষত বাদশাহ শাহজাহানের তৈরিকৃত তাজমহল মোগল স্থাপত্যরীতির ঐতিহ্যকে যুগযুগ ধরে বিশ্ব দরবারে সমাসীন করে রেখেছে। আধুনিক নগরায়ণের অগ্র যাত্রায় কোনোভাবেই মোগল সাম্রাজ্য পিছিয়ে নেয়। বরং তাদের নগরায়ণে সমকালীন বিভিন্ন স্থাপত্য রীতির মিশ্রণ ঘটেছিলো, যা তাকে আপন সময়ে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

Jubokantho24 Ad
এ জাতীয় আরো সংবাদ
এ জাতীয় আরো সংবাদ